মুহাসাবা
মূল : মুহাম্মাদ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ
অনুবাদ : মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআলার, যিনি সৃষ্টিকুলের পালনকর্তা। ছালাত ও সালাম আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপর, যিনি নবী ও রাসূলকুলের শ্রেষ্ঠ। সেই সঙ্গে ছালাত ও সালাম তাঁর পরিবারবর্গ ও ছাহাবীগণের সকলের উপর।
মনের হিসাব গ্রহণ মুমিনদের জীবন চলার পথ; আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসীদের চিহ্ন বা প্রতীক এবং আল্লাহর প্রতি বিনীতজনদের পরিচয়। ফলে যে মুমিন তার রবকে সমীহ করে চলে, নিজের কথা ও কাজের মুহাসাবা করে এবং তার গোনাহের জন্য নিজ রবের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে সে জানে মনের বিপদ ভয়ানক, তার রোগ-ব্যাধি মারাত্মক, তার চক্রান্ত ভয়াবহ এবং তার অনিষ্টতা ব্যাপক বিস্তৃত।
মন প্রতিনিয়ত মন্দের আদেশ দেয়, কুপ্রবৃত্তির দিকে ধাবিত করে, অজ্ঞতার দিকে ডাকে, ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে চলে এবং অসার ক্রীড়া-কৌতুকে মত্ত করে। তবে আল্লাহ যার উপর দয়া করেন সে তার খপ্পর থেকে আত্মরক্ষা করতে পারে। সুতরাং মনকে তার প্রবৃত্তির হাতে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। তাহলে সে তাকে আল্লাহর অবাধ্যতার পথে ঠেলে দিবে। যে প্রবৃত্তির দাসত্ব করে প্রবৃত্তি তাকে কুপথে নিয়ে যায়, কুরুচিপূর্ণ কাজের দিকে তাকে আহবান জানায় এবং নানা নিন্দনীয় কাজে তাকে লিপ্ত করে।
এজন্য মানুষের উচিত, আল্লাহর দরবারে ওযন হওয়ার আগে নিজেই নিজের ওযন করা, তার নিকট হিসাব দেওয়ার আগে নিজেই নিজের হিসাব নেওয়া এবং আল্লাহর সামনে নিজেকে তুলে ধরার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্ত্ততি গ্রহণ করা। মানুষের নিজের হিসাব নিজে গ্রহণ সম্পর্কে যত কথা বলা হয়েছে আমরা এই পুস্তিকায় তার সামান্য কিছু তুলে ধরতে চেষ্টা করব ইনশাআল­াহ।
পুস্তিকাটি অন্তরের আমল সম্পর্কে আমার রচিত বারটি ছোট পুস্তিকার শেষ রচনা। মহান আল্লাহ একটি আলোচনা মাহফিলে আমাকে এগুলো আলোচনার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। আলোচনাগুলো তৈরিতে যাদ গ্রুপের একদল চৌকস জ্ঞানীজন আমাকে সহায়তা করেছিলেন। আল্লাহর রহমতে আজ তা ছাপার অক্ষরে বের হতে যাচ্ছে। ফালিল্লাহিল হাম্দ।
পরিশেষে আমরা আল্লাহর নিকট সদাচার, তাক্বওয়া এবং যা তিনি ভালোবাসেন ও যাতে রাযি-খুশী হন তার যোগ্যতা লাভের আবেদন জানাই- আমীন।

মুহাসাবার পরিচয়ঃ
বাংলা ভাষায় হিসাব-নিকাশ দুটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ। আরবীতে দুটি শব্দই মাছদার। বাংলায় মাছদারকে ক্রিয়ামূল বা ধাতু বলে। এই হিসাব শব্দেরই আরেকটি প্রতিরূপ মুহাসাবা। শব্দটি বাব (مفاعلة)-এর মাছদার। এটি মাযীদ ফীহবা অতিরিক্ত হরফ যোগে গঠিত ক্রিয়ার মাছদার। অভিধান অনুসারে মুহাসাবাহিসাবশব্দের অর্থ পূর্ণরূপে গণনা করা। শব্দটির আরেকটি অর্থ, হিসাব যাচাই করা।
মুজাররাদ বা মূল শব্দে গঠিত হাসিবা-ইয়াহসাবুক্রিয়া হলে তখন অর্থ হবে- গণনা করল, গুণল। হুসবানহিসাবাহঅর্থ গণনা করা।

পরিভাষায় মুহাসাবাঃ
মুহাসাবার আভিধানিক অর্থের সাথে পারিভাষিক শব্দের যোগ রয়েছে। সাধারণত নিজের গোনাহ-অপরাধ এবং দোষ-ত্রুটি হিসাব করাকে মুহাসাবা বলে।
মাওয়ার্দী বলেছেন, أن يتصفح الإنسان في ليله ما صدر من أفعال نهاره، فإن كان محمودًا أمضاه وأتبعه بما شاكله وضاهاه، وإن كان مذمومًا استدركه إن أمكن، وانتهى عن مثله في المستقبل،  ব্যক্তি রাতের কোন সময়ে তার দিনের কাজগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখবে। যদি সেগুলি ভাল ও প্রশংসনীয় হয় তাহলে তা যথারীতি বহাল রাখবে এবং ভবিষ্যতে অনুরূপ কাজ সামনে এলে তা করে যাবে। আর যদি তার কাজগুলো নিন্দনীয় হয় তাহলে যথাসম্ভব তার প্রতিকার করবে এবং ভবিষ্যতে ঐ জাতীয় কাজ থেকে বিরত থাকবে
জনৈক বিদ্বান মুহাসাবার সংজ্ঞায় বলেছেন,قيام العقل على حراسة النفوس من الخيانة فيتفقد زيادتها ونقصانها، ويسأل عن كل فعل يفعله لمَ فعلته، ولمن فعلته؟ فإن كان لله مضى فيه، وإن كان لغير الله امتنع عنه، وأن يلوم نفسه على التقصير والخطأ، وإذا أمكن المعاقبة أو صرفها إلى الحسنات الماحية، মুহাসাবা হ, মানুষের মন যাতে দায়িত্বরূপী আমানতের খিয়ানত না করে সেজন্য বিবেককে মনের পাহারাদার নিযুক্ত করা। মন কোথায় বাড়াবাড়ি করছে এবং কোথায় ত্রুটি করছে বিবেক তা খতিয়ে দেখবে। সে তার প্রতিটি কাজ কেন করেছে, কার জন্য করছে তা তাকে জিজ্ঞেস করবে। যদি কাজগুলো আন্তরিকভাবে আল্লাহ তাআলার জন্য হয় তাহলে তা বহাল রাখবে। আর যদি তা আল্লাহ ছাড়া অন্যের উদ্দেশ্যে হয় তাহলে ভবিষ্যতে তা থেকে বিরত থাকবে। বর্তমান দোষ-ত্রুটির জন্য মনকে তিরস্কার করবে এবং ঐ দোষ-ত্রুটির প্রতিবিধান সম্ভব হলে কিংবা তা মোচনকারী কোন ছওয়াবের কাজ করতে পারলে তা করবে।
সুতরাং মুহাসাবা হ, নিজের কথা ও কাজের ভাল-মন্দ হিসাব ও যাচাই করে মন্দ যা মিলবে তা সংশোধন করা এবং সৎ ও ভাল যা পাবে তা করে যাওয়া।

মুহাসাবার মূলভিত্তিঃ
আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা তার বান্দাদেরকে নিজের হিসাব নিজে গ্রহণের আদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَلْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَا قَدَّمَتْ لِغَدٍ وَاتَّقُوا اللهَ إِنَّ اللهَ خَبِيْرٌ بِمَا تَعْمَلُوْنَ، وَلَا تَكُوْنُوْا كَالَّذِيْنَ نَسُوْا اللهَ فَأَنْسَاهُمْ أَنْفُسَهُمْ أُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُوْنَ، হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আর প্রত্যেক ব্যক্তির উচিৎ এ বিষয়ে ভেবে দেখা যে, সে আগামী দিনের জন্য কি অগ্রিম প্রেরণ করছে? আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে সম্যক অবহিত। আর তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে। অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে আত্মভোলা করে দিয়েছেন। ওরা হল অবাধ্য (হাশর ৫৯/১৮-১৯)
এই আয়াতের তাফসীরে ইবনু সাদী (রঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা তার মুমিন বান্দাদেরকে আদেশ করেছেন যে, তারা যেন ঈমানের দাবী অনুযায়ী কি গোপনে কি প্রকাশ্যে সর্বাবস্থায় তাক্বওয়া অবলম্বন করে, তিনি তাদেরকে শারীআহ, হুদূদ ও অন্যান্য যেসব বিষয়ে আদেশ-নিষেধ করেছেন তা যেন তারা খুব খেয়াল করে মেনে চলে, কোনটা তাদের পক্ষে আর কোনটা বিপক্ষে যাবে এবং তাদের অর্জিত আমল ক্বিয়ামতের দিন তাদের জন্য কতটা লাভজনক হবে ও কতটা ক্ষতিকর হবে তা যেন তারা ভেবে দেখে। কেননা তারা যখন আখিরাতকে তাদের জীবনের লক্ষ্য ও মনের কিবলা বানাবে এবং আখিরাতের অবস্থানের প্রতি গুরুত্ব দিবে, তখন যেসব আমলের দরুন তারা আখিরাতে একটি ভাল অবস্থান লাভ করতে পারবে তা করতে উঠেপড়ে লাগবে, আর যে সকল বাধা-বিপত্তি তাদের আখিরাতমুখী আমলের গতি রুদ্ধ করবে কিংবা গতিপথ পাল্টে দিবে তা থেকে তাদের আমল পরিচ্ছন্ন রাখতে তারা সচেষ্ট থাকবে। তদুপরি যখন তারা মনে রাখবে যে, আল্লাহ তাদের সব কাজের খবর রাখেন, তাদের কোন কাজই তার নিকট গোপন থাকে না, কোন কাজই তার কাছ থেকে নষ্ট হয়ে যায় না এবং কোন কাজকেই তিনি নগণ্য বা তুচ্ছ ভাবেন না তখন তারা আবশ্যিকভাবে তাদের কাজের গতি বাড়িয়ে দিবে।
এই পবিত্র আয়াত বান্দার নিজের হিসাব নিজে গ্রহণের মূলভিত্তি। বান্দার কর্তব্য নিজের কাজের খোঁজ-খবর রাখা। কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখতে পেলে তার প্রতিকার হিসাবে সে ভবিষ্যতে কাজটি থেকে পুরোপুরি বিরত থাকবে, ঐ কাজে প্ররোচিত হওয়ার পেছনে যেসব কারণ রয়েছে তা এড়িয়ে চলবে এবং খালেছ দিলে তওবা করবে। যদি সে নিজের মধ্যে আল্লাহর কোন আদেশ পালনে অমনোযোগ লক্ষ্য করে তাহলে সেই অমনোযোগ কাটাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করবে এবং আদেশটি যাতে অমনোযোগ কাটিয়ে দৃঢ়তার সাথে যথার্থরূপে সম্পন্ন করা যায় সেজন্য স্বীয় রবের কাছে ব্যাকুল চিত্তে দোআ করবে।  আল্লাহর আদেশ পালনে তার অমনোযোগ-অবহেলা সত্ত্বেও তার উপর আল্লাহ পাক কত বেশী অনুগ্রহ ও দয়া করে যাচ্ছেন তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করবে। এতে তার মধ্যে অবশ্যই নিজের আমলের ঘাটতি দেখে লজ্জা অনুভূত হবে।
বান্দা যদি নিজের আমলের এভাবে হিসাব-নিকাশ ও যাচাই-বাছাই করা থেকে গাফিল ও উদাসীন হয়ে বসে থাকে তাহলে তার থেকে বদনছীব ও হতভাগা আর কেউ হয় না। সে তখন ঐ লোকদের শ্রেণীভুক্ত হয়ে যাবে যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে, তাকে স্মরণ করা ও তার হক আদায়ে গাফলতি করেছে এবং নিজেদের মন ও প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণে তৎপর হয়েছে। ফলশ্রুতিতে তারা সফলতা লাভ করতে পারেনি এবং কোন সুবিধাও অর্জন করতে পারেনি। এমতাবস্থায় আল্লাহ তাদের নিজেদের যা করা উচিৎ ছিল তা ভুলিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের জন্য যা উপকার ও মঙ্গল বয়ে আনত তার সম্পর্কে তাদেরকে বে-খবর ও উদাসীন করে দিয়েছেন। ফলে তাদের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে আত্মঘাতী ও বাড়া-বাড়িমূলক। দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতিই এখন তাদের বিধিলিপি। তারা এতটাই প্রতারিত যে তার প্রতিকারের কোন উপায় তাদের হাতে নেই এবং তাদের ভগ্নদশা নিরাময়েরও কোন ব্যবস্থা নেই। কারণ তারা তো ফাসিক বা পাপাচারী।
আল্লাহ তাআলা তার প্রিয় কিতাবে বলেছেন,إِنَّ الَّذِيْنَ اتَّقَوْا إِذَا مَسَّهُمْ طَائِفٌ مِنَ الشَّيْطَانِ تَذَكَّرُوْا فَإِذَا هُمْ مُبْصِرُوْنَ، নিশ্চয়ই যারা আল্লাহকে ভয় করে, শয়তানের কুমন্ত্রণা স্পর্শ করার সাথে সাথে তারা সচেতন হয়ে যায় এবং তাদের জ্ঞানচক্ষু খুলে যায় (রাফ ৭/২০১)
মুত্তাকীদের বিষয়ে আল্লাহ বলছেন যে, তারা যখন শয়তানের ধোক­ায় পড়ে কোন পাপ কাজ করে বসে তখন আল্লাহকে মনে করে তার দিকে ফিরে আসে এবং তাওবা করে। মুত্তাক্বীরা যত কাজ করে মনে মনে তার হিসাব ব্যতীত এ তওবা ও আল্লাহকে মনে করা আদৌ সম্ভব নয়।

মুহাসাবা সম্পর্কে হাদীছের ভাষ্যঃ
শাদ্দাদ বিন আওস (রাঃ) কর্তৃক নবী করীম (ছাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,الْكَيِّسُ مَنْ دَانَ نَفْسَهُ وَعَمِلَ لِمَا بَعْدَ الْمَوْتِ وَالْعَاجِزُ مَنْ أَتْبَعَ نَفْسَهُ هَوَاهَا وَتَمَنَّى عَلَى اللهِ، বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি, যে নিজের মনের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে এবং মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের জন্য কাজ করে। আর নির্বোধ সেই ব্যক্তি যে নিজের মনকে তার কামনা-বাসনার অনুগামী বানিয়ে দেয় এবং  আল্লাহর  কাছে  অহেতুক  আশা
করে ইমাম তিরমিযী বলেছেন, دان نفسه অর্থ: ক্বিয়ামত দিবসে হিসাবের মুখোমুখি হওয়ার আগে কোন ব্যক্তি দুনিয়াতে নিজ মনের হিসাব নেয়।

মুহাসাবার উপর ইজমাঃ
আলিমদের সর্বসম্মত মতে, নিজ মনের হিসাব নেওয়া একটি যরূরী বা আবশ্যকীয় কাজ। ইয বিন আব্দুস সালাম (রহঃ) বলেন, ‘মনের উপর অতীত ও ভবিষ্যতের আমলের যাচাই-বাছাই বা মুহাসাবা আবশ্যিক হওয়ার বিষয়ে আলেমগণ ইজমা করেছেন

মন ও তার ব্যাধিঃ
মানব মনকে যদি মানুষ কুরআন ও সুন্নাহর নীতিমালা অনুযায়ী না চালায় তাহলে মনই চালকের আসনে বসে মানুষকে ধ্বংস ও বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিবে। এই মনকে সোজা রাস্তায় চালাতে মনের প্রতিটি গতিবিধি ও বিপজ্জনক বাঁকের হিসাব গ্রহণ বা মুহাসাবার কোন বিকল্প নেই। জনৈক ব্যক্তি বলেছেন,النفس كالشريك الخوان، إن لم تحاسبه ذهب بمالك মন একজন আত্মসাৎকারী শরীকের মতো। যদি তুমি তার হিসাব-নিকাশ না নাও তাহলে সে তোমার ধন-দৌলত আত্মসাৎ করবে
মন যখন দূষিত হয়ে যায় তখন তাতে আত্মার ব্যাধি বাসা বাঁধে। এ সম্পর্কে ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘আত্মার যত রোগ হয় তার সবগুলোর উৎপত্তি মন থেকে। দূষিত উপকরণগুলো প্রথমে মনে বাসা বাঁধে, তারপর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হাজত বা প্রয়োজনের জন্য প্রদত্ত খুতবায় বলতেন,وَنَعُوْذُ بِاللهِ مِنْ شُرُوْرِ أَنْفُسِنَا وَمِنْ سَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا، আমরা আল্লাহর নিকট আমাদের মনের অপকারিতা ও আমাদের আমলের জঘন্যতা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি
তিনি সাধারণভাবে মনের অপকার থেকে আশ্রয় তো চেয়েছেনই, সেই সঙ্গে মনের খেয়াল-খুশিতে করা কাজের ফলে যে ক্ষতি হয় এবং সেজন্য যে ঘৃণা ও শাস্তির মুখোমুখি হতে হয় তা থেকেও আশ্রয় চেয়েছেন।
আল্লাহর পথের পথিকগণ তাদের পথের ভিন্নতা ও সুলূক বা রীতি-নীতির পার্থক্য সত্ত্বেও এ কথায় একমত যে, আত্মা যাতে পরমাত্মার সান্নিধ্য লাভ করতে না পারে সেজন্য মন উভয়ের মাঝে বাধা তৈরি করে। কাজেই মনকে কাবু করতে না পারলে এবং তাকে মন্দ থেকে রুখতে না পারলে আল্লাহর সাক্ষাৎ ও তার নৈকট্য লাভ সম্ভব হবে না। মনের দিক দিয়ে মানুষ দুই প্রকার : এক প্রকার, যারা মনের হাতে বন্দী। মন তাদের গোলাম বানিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। নাকে বরশি পরিয়ে সে তাদেরকে যে দিকে চলতে বলে তারা সেদিকেই চলে।
আরেক প্রকার, যারা মনকে কাবু ও পরাভূত করে নিজেদের আয়ত্ববাধীন করে নিয়েছে। ফলে মন তাদের অনুগত, তারা মনকে যে আদেশ করে মন তা পালন করে। জনৈক আরেফ দরবেশ বলেছেন, আল্লাহর পথের সন্ধানীরা যখন তাদের মনকে নিজেদের বশীভূত করতে পারে তখনই কেবল তারা সফরের শেষ পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে। অনন্তর যে নিজের মনকে পরাজিত করবে সে সফল হবে, আর মন যাকে পরাজিত করবে সে বিফল ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন,فَأَمَّا مَنْ طَغَى، وَآثَرَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا، فَإِنَّ الْجَحِيمَ هِيَ الْمَأْوَى، وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى، فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى- ‘অনন্তর যে অবাধ্য হবে এবং দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দিবে তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম। আর যে তার প্রভুর সামনে দাঁড়ানোর ভয় করবে এবং মনকে প্রবৃত্তি বা খেয়াল-খুশীর অনুসরণ থেকে বিরত রাখবে তার ঠিকানা হবে জান্নাত (নাযিয়াত /৩৭-৪১)
বস্ত্তত মন অবাধ্যতা ও দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য প্রদানের দিকে ডাকে। অন্য দিকে রববুল আলামীন বান্দাকে তাঁর ভয় করতে এবং মনকে প্রবৃত্তি বা খেয়াল-খুশীর অনুসরণ থেকে বিরত রাখতে  বলেন। এ ক্ষেত্রে আত্মার অবস্থান হয় উভয় আহবানকারীর মাঝে। একবার সে মনের দিকে ঝোঁকে তো অন্যবার তার রবের দিকে ঝোঁকে। এভাবেই দুনিয়ার পরীক্ষাকেন্দ্রে মানুষ পরীক্ষা দিয়ে চলেছে।

কুরআনে মনের বিবরণঃ
আল-কুরআনে আল্লাহ তিন প্রকার মনের কথা বলেছেন। যথা : প্রশান্ত মন (المطمئنة), ভৎর্সনাকারী মন (اللوامة) ও মন্দপ্রবণ মন (الأمارة بالسوء)

প্রশান্ত মনঃ
মন যখন আল্লাহর জন্য আমলে আরাম বোধ করে, তার যিকিরে প্রশান্তি লাভ করে, তার দিকে নিবিষ্ট হয়, ক্বিয়ামত দিবসে তার সাক্ষাৎ লাভে আগ্রহী হয় এবং তার নৈকট্য প্রাপ্তির কাজে স্বস্তি পায় তখন তাকে প্রশান্ত মন বলে। আরবীতে বলে নাফসে মুতমায়িন্নাহ’ (نفس مطمئنة) এই মনের অধিকারীর জান কবয কালে আল্লাহর পক্ষ থেকে ডেকে বলা হয়,يَا أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ، ارْجِعِي إِلَى رَبِّكِ رَاضِيَةً مَرْضِيَّةً، فَادْخُلِي فِي عِبَادِي، وَادْخُلِي جَنَّتِي، হে প্রশান্ত আত্মা! ফিরে চলো তোমার প্রভুর পানে, সন্তুষ্ট চিত্তে ও সন্তোষভাজন অবস্থায়। অতঃপর প্রবেশ কর আমার বান্দাদের মধ্যে এবং প্রবেশ কর আমার জান্নাতে (ফাজর ৮৯/২৭-৩০)

প্রশান্তির হাকীকত বা মূল তাৎপর্যঃ
আরবী الطمأنينة (তুমানাহ) অর্থ আরাম ও স্থিরতা। যেহেতু বান্দা আল্লাহর আনুগত্য করে, তার যিকির ও স্মরণে লিপ্ত থাকে এবং তারই আদেশ-নিষেধ মেনে চলে সেহেতু সে তার কাছেই আরাম পায়, তাকে ছেড়ে অন্য কারও কাছে সে আরাম বোধ করে না। সে শান্তি পায় আল্লাহকে ভালবেসে, তার ইবাদত করে, তার দেয়া খবরে ও তার দর্শন লাভের উপর ঈমান রেখে। শান্তি পায় আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর তাৎপর্য বুঝে সেগুলোর উপর অন্তর থেকে বিশ্বাস স্থাপন করে। সে শান্তি পায় আল্লাহকে তার প্রভু, ইসলামকে তার দ্বীন বা ধর্ম এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে রাসূল হিসাবে মেনে নিয়ে তাতে রাযী-খুশী থাকতে। তার স্বস্তি মেলে আল্লাহর ফায়ছালা ও তাক্বদীরে, তাকেই যথেষ্ট ও পর্যাপ্ত মনে করাতে। সে খুবই আশ্বস্ত থাকে যে, আল্লাহ তাকে সকল প্রকার মন্দ থেকে দূরে রাখবেন; প্রত্যেক চক্রান্তকারীর চক্রান্ত হিংসুকের হিংসা ও শত্রুর শত্রুতা থেকে রক্ষা করবেন। সে এতে পরিতৃপ্তি পায় যে, এক আল্লাহই তার প্রতিপালক, তার ইলাহ, তার মাবূদ, তার উপাস্য, তার মালিক, তার মুখতার। অন্য কারও তার উপর কোন ভাগ নেই। তার কাছেই তার ফিরে যাওয়ার জায়গা। এক পলকের জন্যও তাকে ছাড়া তার চলে না। এই মনই হল প্রশান্ত মন বা নাফসে মুতমায়িন্নাহ

মন্দপ্রবণ মনঃ
প্রশান্ত মনের বিপরীত ও বিরোধী মন হল মন্দপ্রবণ মন আরবীতে বলা হয় নাফসে আম্মারা। মন্দপ্রবণ মন মানুষকে খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করতে হুকুম করে এবং ভুল ও বাতিল পথে চলতে উৎসাহিত করে। সে সকল মন্দের আশ্রয়কেন্দ্র। সবাইকে সে বিশ্রী ও ঘৃণ্য কাজের দিকে টানে। আল্লাহ তাআলা বলেন, إِنَّ النَّفْسَ لَأَمَّارَةٌ بِالسُّوْءِ إِلَّا مَا رَحِمَ رَبِّي، নিশ্চয়ই মানুষের মন মন্দপ্রবণ। কেবল ঐ ব্যক্তি ছাড়া যার প্রতি আমার প্রভু দয়া করেন (ইউসুফ ১২/৫৩) আল্লাহ আম্মারাহবলেছেন, ‘আমেরাহবলেননি। কেননা আম্মারাহ’-এর মধ্যে অতিশয়তার অর্থ রয়েছে। এজন্যই এ ধরনের মন মন্দের বেশী বেশী হুকুম দেয়।
নাফস বা মন সহজাতভাবেই অত্যাচারী ও অজ্ঞ-মূর্খ (যালিম ও জাহিল)। ফলে মানুষের মন সদাই অন্যের ও নিজের উপর অত্যাচার করতে চায় এবং নিজের ভাল-মন্দ বিবেচনায় না নিয়ে মূর্খের মত কাজ করে। তবে আল্লাহ যাকে দয়া করে তার খপ্পর থেকে রক্ষা করেন তার কথা আলাদা।
আল্লাহ বলেন,وَاللهُ أَخْرَجَكُمْ مِنْ بُطُونِ أُمَّهَاتِكُمْ لَا تَعْلَمُونَ شَيْئًا، আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের মায়ের গর্ভ থেকে বের করে এনেছেন এমন অবস্থায় যে তোমরা কিছুই জানতে না (নাহল ১৬/৭৮) إِنَّ الْإِنْسَانَ لَظَلُومٌ كَفَّارٌ নিশ্চয় মানুষ অতিবড় যালেম ও অকৃতজ্ঞ (ইবরাহীম ১৪/৩৪)
হ্যঁা, জন্মকালে তার মধ্যে হক বা সত্য গ্রহণ করার যোগ্যতা তৈরি করে দেওয়া হয়। তাই তার সামনে হক বা সত্য তুলে ধরা হলে বাইরের কোন খারাপ প্রভাবে প্রভাবিত না হলে সে তা গ্রহণ করে।
আল্লাহ বলেন,فَأَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًا،  অতএব তুমি নিজেকে একনিষ্ঠভাবে ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখ। আল্লাহর ধর্ম, যার উপরে তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন (রূম ৩০/৩০) কিন্তু নাফস বা মনকে আল্লাহর দ্বীন শিক্ষা দেওয়া না হলে সে জাহিল-মূর্খই থেকে যায়, তার মধ্যে কুপ্রবৃত্তি গিজগিজ করে।
ফলে শিক্ষা-দীক্ষা ও প্রশিক্ষণ না পেলে মন মানুষকে অবাধ্যতার দিকে ডাকে এবং মন্দ কাজে ঠেলে দেয়। সুতরাং আদল-ইনছাফ ও বিদ্যা-বুদ্ধি মানুষের মনের অর্জিত বিষয়, এগুলো সহজাত নয়।
মুমিনদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না হলে তাদের কেউই পূত-পবিত্র থাকতে পারত না। তিনি কোন মনের ভাল চাইলে তাকে দ্বীনের জ্ঞান অর্জন এবং শরীআত মোতাবেক আমলের সক্ষমতা দান করেন।

মন্দপ্রবণ মনের অত্যাচারী হওয়ার কারণঃ
মন হয়তো কোন জিনিস সম্পর্কে জানে না, কিংবা তাতে তার প্রয়োজন রয়েছে তাই সে তা ছলেবলে যে কোন অসদুপায়ে হাছিল করতে তার মালিককে সদাই প্ররোচিত করে। যেন তার তা না হলে চলবেই না। হ্যঁা আল্লাহর রহমতই কেবল মনকে এহেন দুর্দশা থেকে রক্ষা করতে পারে। এজন্যই বান্দা বুঝতে পারে যে, সে সদাই আল্লাহর মুখাপেক্ষী। তার মনের অনিষ্ট ও ক্ষতি থেকে কেবল আল্লাহই তাকে বাঁচাতে পারেন। অতএব আল্লাহর প্রয়োজন মানুষের নিকট সকল প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে; এমনকি তার খাদ্য-পানীয় ও শ্বাস-প্রশ্বাসের চাইতেও বেশী।

ভৎর্সনাকারী মনঃ
ভাল-মন্দের মিশেলে যে মন গড়ে ওঠে তাই ভৎর্সনাকারী মন। এ ধরনের মন ভাল কাজ কেন ছেড়ে দেওয়া হ, মন্দ কাজ কেনই বা করা হল তা বলে তার মালিককে ভৎর্সনা বা তিরস্কার করে। আরবীতে বলা হয় নাফসে লাওয়ামালাওমমূল থেকে লাওয়ামাশব্দ গঠিত। বাংলায় প্রচলিত মালামতশব্দের মূলও লাওম। মালামত অর্থ ভৎর্সনা বা তিরস্কার।
হাসান বছরী (রহঃ) বলেন,إن المؤمن، والله، ما تراه إلا يلوم نفسه على كل حالاته؛ يستقصرها فى كل ما يفعل فيندم ويلوم نفسه، وإن الفاجر ليمضى قدما لا يعاتب نفسه আল্লাহর কসম! তুমি মুমিনকে সর্বাবস্থায় নিজের মনকে তিরস্কার করতে দেখতে পাবে। তার সব কাজেই সে কিছু না কিছু ত্রুটি খুঁজে পায়। তাই কেন এ ত্রুটি হল তা ভেবে সে লজ্জিত ও অনুশোচিত হয় এবং মনকে সে জন্য তিরস্কার করে। পক্ষান্তরে পাপাচারী দুষ্কৃতিকারী অসংকোচে অন্যায়-অপকর্ম করে, তা নিয়ে মনকে সে কদাচিৎই ভৎর্সনা করে
ভৎর্সনাকারী মন এমনকি ক্বিয়ামত দিবসেও ব্যক্তিকে তিরস্কার করবে। যদি সে নেককার হয় তাহলে তার সামনে বিভিন্ন মানের জান্নাত দেখে সে কেন বেশী বেশী নেকী করল না সে কথা বলে তিরস্কার করবে। আর যদি বদকার হয় তাহলে তার সামনে জাহান্নাম দেখে সে দুনিয়াতে কেন বদ কাজ করেছে সে কথা বলে অনুতাপ করবে। সুতরাং এ মন দুনিয়াতেও তিরস্কার করবে, আখিরাতেও তিরস্কার করবে। সুতরাং মন কখনও মন্দপ্রবণ, কখনও ভৎর্সনাকারী এবং কখনও প্রশান্ত হয়।

মন্দপ্রবণ মনের অত্যাচারী হওয়ার কারণঃ
মন প্রশান্ত হওয়া মনের একটি প্রশংসনীয় গুণ, আর মন্দপ্রবণ হওয়া মনের একটি নিন্দনীয় গুণ, আর ভৎর্সনাকারী মন হলে যে জন্য ভৎর্সনা করা হচ্ছে  তার গুণ অনুসারে তা কখনও প্রশংসনীয়, আবার কখনও নিন্দনীয় হবে।
এমন ভাবার কোনই অবকাশ নেই যে, কেউ প্রশান্ত মনের অধিকারী হলে চিরকালই সে প্রশান্ত মনের অধিকারী থাকবে। আবার কেউ মন্দপ্রবণ মনের অধিকারী হলে চিরকালই তার মন মন্দপ্রবণ থাকবে। বরং একসময় তা প্রশান্ত হলে অন্য সময় মন্দপ্রবণ হবে, আবার কখনও ভৎর্সনাকারী হবে। বরং একই দিনে, একই ঘণ্টায় তা পরিবর্তিত বা উলটপালট হতে পারে। তখন গুণ বিচারে তার মধ্যে কোন মন বিরাজ করছে তা হিসাব করতে হবে।
সুতরাং হে পাঠক, আপনি নির্জনে নিরিবিলি পরিবেশে নিজের মনের হিসাব নিজে করুন। জীবনের যে সময় পার হয়ে গেছে তা নিয়ে ভাবুন। ব্যস্ততার মুহূর্তে যে আমল করা সম্ভব হয়নি অবসর সময়ে তা করুন। কাজ করার আগে চিন্তা করুন যে এ কাজে আপনার আমলনামায় নেকী-বদী কোনটা লেখা হবে? লক্ষ্য করুন, আপনার শ্রম-সাধনায় আপনার মন কি আপনার পক্ষে, না বিপক্ষে? সে নিশ্চয়ই সৌভাগ্য অর্জন করবে, যে মনের হিসাব নিবে। যে মনের সাথে যুদ্ধ করবে, মনের কাছে তার পাওনাদি আদায় করে ছাড়বে, যখনই মন কোন অন্যায় করে বসবে তখনই তাকে গালমন্দ করবে, যখনই কোন ক্ষেত্রে সে একাত্মতা প্রকাশ করবে তখনই তাকে কাছে টেনে নিবে এবং যখনই মন খেয়াল-খুশির লোভে মত্ত হবে তখনই তাকে পরাভূত করবে। আল্লাহর কসম! জীবনে সে সফল হবে।

মুহাসাবায় কড়াকড়িঃ
কৃপণ ও লোভী অংশীদার যেমন তার অন্য অংশীদারদের থেকে নিজের পাওনা কড়ায়-গন্ডায় বুঝে নেয়, তেমনি করে মানুষ নিজের মনের নিকট থেকে নিজের কথা ও কাজের হিসাব বুঝে না নেওয়া পর্যন্ত সে মুত্তাকীদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে না। মায়মূন বিন মিহরান (রঃ) বলেছেন,لا يكون الرجل تقيا حتى يحاسب نفسه أشد من محاسبة الرجل شريكه، حتى ينظر من أين مطعمه ومشربه ومن أين مكسبه؟ শরীক থেকে নিজের পাওনা বুঝে নিতে মানুষ যত না কঠিন-প্রাণ হয়, নিজের মন থেকে নিজের কথা ও কাজের হিসাব বুঝে নিতে তার থেকেও বেশী কঠিন মনষ্ক না হওয়া অবধি সে মুত্তাকী হতে পারবে না। এমনকি কোত্থেকে তার খাদ্য-পানীয় ও আয়-রোযগার হচ্ছে তাও সে গভীরভাবে লক্ষ্য করবে তিনি আরো বলেছেন, ‘একজন মুত্তাকী তার মনের হিসাব গ্রহণে কৃপণ ও লোভী অংশীদার কর্তৃক হিসাব গ্রহণ থেকেও মহাকঠোর
সুতরাং মুহাসাবায় কড়াকড়ি করলে সেই মুহাসাবা থেকে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু মুহাসাবায় গা ছাড়া যেন-তেন ভাব দেখালে তা কোন মুহাসাবাই হবে না। তা বরং মনের জন্য সবকিছু হালাল করার পাঁয়তারা। যার ফলে মনের বিভ্রান্তি আরও বেড়ে যাবে। অনেকেই মুহাসাবা করতে গিয়ে বলে, ‘এ আমল তো ছোটখাট আমল; ‘এ আমল হারাম হওয়া নিয়ে আলেমদের মধ্যে মতভেদ আছে; ‘জোরালো মতানুসারে এ আমল মাকরূহইত্যাদি ইত্যাদি। এভাবে নানা ছুতো তুলে সে ঐসব আমল করে। এভাবে একসময় মন লাগামহীন কাজে জড়িয়ে পড়ে।

সবকিছুতেই মুহাসাবাঃ
আল্লাহ তাআলার বাণী وَلَا أُقْسِمُ بِالنَّفْسِ اللَّوَّامَةِ এবং শপথ করছি ধিক্কার দানকারী অন্তরের (বিবেকের) (ক্বিয়ামাহ ৭৫/২) সম্পর্কে সাঈদ বিন জুবায়ের (রহঃ) বলেন, সে (ভৎর্সনাকারী মন) ভাল-মন্দ উভয়ের জন্য ভৎর্সনা করে। হাসান বছরী (রহঃ) বলেন, إِنَّ الْمُؤْمِنَ لَا تَرَاهُ إِلَّا يَلُومُ نَفْسَهُ، يَقُولُ مَا أَرَدْتُ بِكَلِمَتِي، يَقُولُ مَا أَرَدْتُ بِأَكْلَتِي، مَا أَرَدْتُ بِحَدِيثِ نَفْسِي، فَلَا تَرَاهُ إِلَّا يُعَاتِبُهَا وَإِنَّ الْفَاجِرَ يَمْضِيْ قُدُمًا فَلَا يُعَاتِبُ نَفْسَهُ- ‘নিশ্চয়ই কোন মুমিনকে তুমি এমন পাবে না, যে তার মনকে ভৎর্সনা করে না। কোন কথা বললে সে বলে, হে মন! আমার এ কথায় তুমি কী বুঝাতে চেয়েছ? কোন কিছু খেলে বলে, আমার এ খাবার গ্রহণে তোমার উদ্দেশ্য কী? মনে মনে কথা বললে বলে, আমার মনে উদিত এ ভাবনায় তুমি কী ইচ্ছা করছ? এভাবে সব ক্ষেত্রেই দেখবে যে, সে মনকে নানা প্রশ্ন তুলে ভৎর্সনা করছে। কিন্তু যে কাফের-ফাসেক সে কোন ভ্রূক্ষেপ না করে সামনে পা ফেলে। ফলে সে তার মনকে ভৎর্সনা করে না
সুতরাং মুহাসাবা কেবল পাপ কাজের সাথে যুক্ত নয়। বরং প্রত্যেকটা মানুষকে তার প্রতিটি কাজে মনের সাথে বুঝাপড়া করতে হবে, এমনকি তার মুবাহ* বা বৈধ কাজেও।

মুহাসাবা শেষে সৎ কাজে মনকে নিবদ্ধ রাখাঃ
যে কাজ তার কাঙ্ক্ষিতফল বয়ে আনে না, নিশ্চয়ই তা ত্রুটিযুক্ত ও অপূর্ণ। কাজটি যিনি করেছেন তাকে দ্বিতীয় বার তা পর্যবেক্ষণ করতে হয়। সুতরাং মুহাসাবা কোন ফল বয়ে না আনলে মুহাসাবাকারীর উপর আরেকবার মুহাসাবা করা আবশ্যক হবে। বরং তাকে এভাবে মুহাসাবার পর মুহাসাবা চালিয়ে যেতে হবে।
মালেক বিন দীনার (রহঃ) বলেছেন, আল্লাহ তাঁর সেই বান্দার উপর দয়া করুন, যে তার মনকে বলে, ‘তুমি কি এটা করনি, তুমি কি ওটা করনি? তারপর তার নাক ছিদ্র করে তাতে লাগাম পরিয়ে দেয় এবং আল্লাহর কিতাব মেনে চলতে বাধ্য করে। এভাবে সে তার মনের চালকের আসনে বসে
ইবরাহীম আত-তায়মী (রহঃ) বলেছেন, একবার আমি মনে মনে কল্পনা করলাম যে, আমি জান্নাতে আছি। জান্নাতের ফল খাচ্ছি, জান্নাতের নহরের পানি পান করছি, জান্নাতের তরুণীদের সঙ্গে আলিঙ্গনাবদ্ধ হচ্ছি। আবার কল্পনা করলাম যে, আমি জাহান্নামে আছি। জাহান্নামের যাক্কূম খাচ্ছি, পুঁজ পান করছি এবং তার শিকল ও বেড়ির শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়ে আছি। এবার আমি আমার মনকে বললাম, মন আমার, তুই কোনটা চাস? মন বলল, আমি দুনিয়াতে ফিরে গিয়ে নেক কাজ করতে চাই। আমি বললাম, তুই তো তোর কাঙ্ক্ষিত স্থানেই আছিস। কাজেই এখনই নেক কাজ কর।

মুহাসাবার ফলঃ
নিশ্চয়ই মনের কথা, কাজ ও কল্পনার হিসাব রাখা সব রকমের কল্যাণ লাভ ও সফলতার পথ। মুহাসাবার ফলে একজন মুসলিম দুনিয়া-আখিরাত উভয় জগতে সৌভাগ্য লাভ করতে পারে। হাসান বছরী (রহঃ) বলেছেন,إِنَّ الْعَبْدَ لا يَزَالُ بِخَيْرٍ مَا كَانَ لَهُ وَاعِظٌ مِنْ نَفْسِهِ، وَكَانَتِ الْمُحَاسَبَةُ مِنْ هِمَّتِهِ. ‘যতক্ষণ কোন বান্দার মুহাসাবা করার সদিচ্ছা থাকবে এবং যতক্ষণ তার নিজের ভেতর একজন উপদেশদাতা থাকবে, ততক্ষণ সে সৎপথে থাকবে নিচে মুহাসাবার কিছু নিশ্চিত সুফল তুলে ধরা হল।-

ক্বিয়ামতের দিন হিসাব সহজ হওয়াঃ
কোন মুসলিম দুনিয়াতে নিয়মিত নিজের মনের হিসাব নিলে ক্বিয়ামতের দিন তা তার হিসাব হাল্কা হওয়ার মাধ্যম হবে। কেননা মুহাসাবার কারণে দুনিয়ার জীবনে তার পাপপ্রবণতা কমে যাবে এবং নেক কাজের প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেছেন,حاسبوا أنفسكم قبل أن تحاسبوا فإنه أهون لحسابكم وزنوا أنفسكم قبل أن توزنوا وتجهزوا للعرض الأكبر، ‘(আল্লাহর নিকটে) তোমাদের হিসাব দানের আগে তোমরা নিজেরা নিজেদের হিসাব গ্রহণ করো এবং (আল্লাহর নিকটে) ওযনের আগে নিজেরা নিজেদের ওযন করো। কেননা এটা করা তোমাদের জন্য তুলনামূলক সহজ। আর তোমরা সবচেয়ে বড় আরয বা হিসাবের জন্য পাথেয় যোগাড় করো। আল্লাহ বলেছেন,يَوْمَئِذٍ تُعْرَضُونَ لَا تَخْفَى مِنْكُمْ خَافِيَةٌ সেদিন তোমাদেরকে উপস্থিত করা হবে। কোনকিছুই তোমাদের গোপন থাকবে না (হাক্কাহ ৬৯/১৮)
জাফর বিন বুরকান (রহঃ) বলেন, আমার নিকট পৌঁছেছে যে, ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) তাঁর এক কর্মকর্তাকে একটি পত্র দিয়েছিলেন, সেই পত্রের শেষাংশে লেখা ছিল,حَاسِبْ نَفْسَكَ فِي الرَّخَاءِ قَبْلَ حِسَابِ الشِّدَّةِ، فَإِنَّهُ مَنْ حَاسَبَ نَفْسَهُ فِي الرَّخَاءِ قَبْلَ حِسَابِ الشِّدَّةِ، عَادَ مَرْجِعُهُ إِلَى الرِّضَا وَالْغِبْطَةِ، وَمَنْ أَلْهَتْهُ حَيَاتُهُ، وَشَغَلَهُ هَوَاهُ، عَادَ مَرْجِعُهُ إِلَى النَّدَامَةِ وَالْحَسْرَةِ، فَتَذَكَّرْ مَا تُوْعَظُ بِهِ، لِكَيْ تُنْهَى عَمَّا يُنْتَهَى عَنْهُ، দুঃসময়ে হিসাব দেওয়ার পূর্বে সুসময়ে তোমার মনের
হিসাব রাখো। কেননা যে দুঃসময়ে হিসাবের পূর্বে সুসময়ে তার মনের হিসাব রাখে, পরিণামে সে পরিতুষ্টি ও ঈর্ষণীয় সাফল্য লাভ করে। আর যাকে তার আয়ুষ্কাল দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে অনাগ্রহী উদাসীন করে দিয়েছে এবং সে খেয়াল-খুশীর বশে ভোগবিলাসে মত্ত থাকছে, পরিণামে সে লাভ করবে আফসোস ও অনুশোচনা। সুতরাং যে বিষয়ের উপদেশ দেয়া হয়, তার শিক্ষা গ্রহণ করো। যাতে যেসব কাজ থেকে বিরত থাকা সঙ্গত তা থেকে বিরত থাকা যায়
হাসান বছরী (রহঃ) বলেছেন, ‘মুমিন তার মনের অভিভাবক। সে আল্লাহর ওয়াস্তে মনের হিসাব রাখে। আর নিশ্চয়ই যে জাতি দুনিয়াতে নিজেদের মনের হিসাব গ্রহণ করে ক্বিয়ামত দিবসে তাদের হিসাব হাল্কা ও আরামদায়ক হবে। আর ক্বিয়ামত দিবসে কেবল তাদের হিসাব কঠিন ও কষ্টদায়ক হবে, যারা হিসাব ছাড়াই জীবন কাটিয়েছে। মুমিনের হঠাৎই কোন জিনিস ভাল লাগলে সে বলে ওঠে, আল্লাহর কসম, নিশ্চয়ই আমি তোমাকে কামনা করি এবং তোমার প্রয়োজনও আমার আছে। কিন্তু আল্লাহর কসম, তোমার নাগাল পাওয়ার সুযোগ আমার হাতে নেই! তোমার ও আমার মাঝে দেয়াল তোলা রয়েছে। আর যদি তার কিছু সামান্য ভোগ করে বসে তাহলে সে মনের কাছে প্রশ্ন তোলে, কোন উদ্দেশ্যে এটা করলে? এটার আমার কী দরকার ছিল? আল্লাহর কসম! আমার তো অজুহাত তোলারও সুযোগ নেই। আল্লাহর কসম! আগামীতে আল্লাহ চাহে তো আমি এ কাজ আদৌ করব না।
ফুযাইল বিন ইয়ায (রঃ) বলেছেন,المؤمن يحاسب نفسه ويعلم أن له موقفا بين يدى الله تعالى، والمنافق يغفل عن نفسه، فرحم الله عبدا نظر لنفسه قبل نزول ملك الموت به، মুমিন তার মনের হিসাব রাখে এবং সে জানে যে, একদিন তাকে আল্লাহ তাআলার সামনে দাঁড়াতে হবে। পক্ষান্তরে মুনাফিক যে, সে জীবন ও মন সম্পর্কে উদাসীন। সুতরাং সেই বান্দার উপর আল্লাহর দয়া বর্ষিত হেŠ, যে তার কাছে মালাকুল মওত আসার আগেই নিজ জীবনের হিসাব নেয়

কোত্থেকে মুহাসাবা শুরু করব?
আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, প্রথমেই ফরয আমল দিয়ে নিজের হিসাব শুরু করবে। তাতে কোন ত্রুটি বুঝতে পারলে কাযা অথবা সংশোধনের মাধ্যমে তার প্রতিবিধান করবে। তারপর নিষিদ্ধ বিষয়ের হিসাব নেবে। যখন সে বুঝতে পারবে যে, সে কোন একটা নিষিদ্ধ কাজ করে ফেলেছে তাহলে তওবা, ইস্তিগফার ও পাপ বিমোচক কোন পুণ্য কাজ করে তার প্রতিবিধান করবে। তারপর গাফলতির হিসাব নিবে। নিজের সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে যদি সে গাফেল থাকে তাহলে আল্লাহর দিকে ফিরে আসা এবং যিকির করার মাধ্যমে সে গাফলতির প্রতিবিধান করবে।
তারপর সে কী কথা বলেছে, কোথায় দুপায়ে হেঁটে গেছে, দুহাত দিয়ে কী ধরেছে, দুকান দিয়ে কী শুনেছে তার হিসাব নিবে। সে ভাববে এ কাজ দ্বারা আমার কী নিয়ত ছিল? কার জন্য আমি এ কাজ করেছি? কোন পদ্ধতিতে কাজটি করেছি? জেনে রাখা দরকার যে, প্রত্যেক হরকত (কাজ) ও কথার জন্য দুটো খাতা (রেজিস্টার) তৈরি করতে হবে। এক খাতায় থাকবে, কার জন্য কাজ করছি তার তালিকা; আরেক খাতায় থাকবে, কীভাবে কাজ করছি তার তালিকা। প্রথমটা ইখলাছ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা এবং দ্বিতীয়টা অনুসরণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা।
আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) নাফস বা মনের হিসাব গ্রহণের একটি কার্যকরী পদ্ধতি তুলে ধরেছেন। তিনি কোত্থেকে মুহাসাবা শুরু করতে হবে এবং তারপর কোনটা করতে হবে তার ধারাবাহিকতা বর্ণনা করেছেন। নিম্নে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হল।-
১. ফরযের হিসাবঃ শরীআতে ফরয বিধান সমূহের প্রতিপালন হারাম সমূহের তরক থেকে ঊর্ধ্বে গণ্য করা হয়েছে। কেননা ফরয পালনই শরীআতের আসল মাক্বছাদ বা উদ্দেশ্য। সুতরাং বান্দা ফরয দিয়ে তার নফসের হিসাব শুরু করবে। যদি তাতে কোন ঘাটতি দেখতে পায় তাহলে ফরয পুনরায় আদায় করে কিংবা বেশী বেশী নফল আদায় করে তা পূরণ করবে। হাঁ, যদি দেখে যে, মূলেই ঐ ফরয শুদ্ধভাবে পালিত হয়নি তাহলে তা পুনর্বার আদায় করবে; আর যদি কিছুটা ত্রুটি হয়ে থাকে তাহলে বেশী পরিমাণ নফল আদায়ের মাধ্যমে তা পূরণ করবে।
২. হারাম ও নিষেধের হিসাবঃ হারাম ও নিষেধের বেলায় নফস বা মনের হিসাব করতে গিয়ে দেখবে যে, সে কোন হারাম কিংবা নিষিদ্ধ কাজ করে ফেলেছে কি-না। তারপর যা তাকে বিপর্যয়ের মুখোমুখি করবে তা সংশোধনের চেষ্টা করবে। উদাহরণ স্বরূপ যদি সে সূদ থেকে হারাম সম্পদ উপার্জন করে তাহলে সূদ খাওয়া ছেড়ে দিবে এবং আসল রেখে যাদের থেকে সূদ নিয়েছে সূদের অর্থ তাদেরকে ফেরত দিবে। আর যদি অন্যদের অধিকার জোর করে নিয়ে থাকে তাহলে তাও তাদের ফেরত দিবে। কারও গীবত, লাঞ্ছনা ও অপমান করলে তাদের থেকে ক্ষমা চেয়ে নিবে, তাদের জন্য দোআ করবে এবং তাদের পক্ষ থেকে দান করবে। আর যদি এমন অন্যায় করে যার বিকল্প প্রতিবিধান নেই। যেমন মদ পান করেছে কিংবা কোন মহিলার দিকে তাকিয়েছে তাহলে অনুশোচনা ও তওবা করবে এবং ভবিষ্যতে এমন যাতে না ঘটে সেজন্য সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞা করবে। সাথে সাথে পাপ মোচনকারী নেক কাজ বেশী বেশী করে করবে। কেননা মহান আল্লাহ বলেছেন,وَأَقِمِ الصَّلَاةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِنَ اللَّيْلِ إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ আর তুমি ছালাত কায়েম কর দিনের দুই প্রান্তে ও রাত্রির কিছু অংশে। নিশ্চয়ই সৎকর্মসমূহ মন্দ কর্মসমূহকে বিদূরিত করে (হূদ ১১/১১৪)
৩. তাকে সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তার গাফলতি বা উদাসীনতার হিসাবঃ সে খেয়াল করবে যে, (হারাম ছাড়াও) অসার গান-বাজনা ও খেলাধূলায় নিজেকে মত্ত রেখেছে কি-না? এমনটা নযরে এলে গাফলতিতে অতিবাহিত সময় থেকে আরও বেশী সময় ধরে যিকির, ইবাদত ও নেক কাজে মশগূল থাকবে। গাফলতির বদলা হিসাবে এটা করবে।
৪. অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের হিসাবঃ সে নিজেকে জিজ্ঞেস করবে-আমার পা দিয়ে, আমার হাত দিয়ে, আমার কান দিয়ে, আমার চোখ দিয়ে, আমার জিহবা দিয়ে আমি কী করেছি? অঙ্গগুলোর কোনটি থেকে কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটে থাকলে প্রতিকার হিসাবে অঙ্গগুলোকে আল্লাহর আনুগত্যমূলক কাজে নিয়োজিত রাখবে।
৫. নিয়তের হিসাবঃ (নিয়ত যাচাইও যরূরী বিষয়)। আমার এ আমল দ্বারা আমার কী ইচ্ছা? এতে আমার নিয়তই বা কী? এভাবে প্রশ্ন করে নিয়ত যাচাই করবে। ক্বলবের হিসাব একান্ত খাছভাবে নিতে হবে। কেননা নিয়তের স্থান ক্বলব, আর ক্বলব হরহামেশাই বদলাতে থাকে, ফলে মুহূর্তের মধ্যেই নিয়তেরও বদল ঘটে। এই বদলানোর জন্যই ক্বলবের নাম হয়েছে ক্বলব।

মনকে শাস্তি প্রদানঃ
মুমিন যখন তার নফস বা মনের হিসাব নিবে তখন দেখতে পাবে, মন কোন না কোন পাপ করেছে, কিংবা ফযীলতমূলক কাজে শিথিলতা ও অলসতা দেখিয়েছে। ফলে যা ছুটে গেছে তার প্রতিকারের জন্য মনকে শাস্তি-সাজা ও আদব শিক্ষা দেওয়া তার কর্তব্য। যাতে ভবিষ্যতে এমনটা আর না ঘটে এবং মন শায়েস্তা ও কর্মতৎপর হয়।
মনকে মুজাহাদা বা কর্মতৎপর না রাখলে, হিসাব না নিলে এবং শাস্তি না দিলে মন সোজা থাকবে না। আশ্চর্য যে, মানুষ কখনো কখনো চারিত্রিক দোষ কিংবা অন্য কোন ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে নিজ পরিবারের সদস্য ও চাকর-বাকরদের শাস্তি দেয়, কিন্তু সে নিজে কোন মন্দ কাজ করলে নিজেকে শাস্তি দেয় না। অথচ নিজেকে শাস্তি দেওয়াই উত্তম ও সুবিবেচনাপ্রসূত কাজ। কখনো কখনো শাস্তির নামে উপেক্ষা ও ছাড় দিতে দেখা যায়। তবে নিজেকে শাস্তি দানের মূল লক্ষ্য নিজের মনকে আল্লাহর অনুগত রাখা এবং আগে করা হয়নি এমন সব ভালো কাজে নিজেকে নিয়োজিত করা। মনকে শাস্তি দানের পূর্বসূরীদের পদ্ধতি এমনই ছিল। এখানে তার কিছু নমুনা তুলে ধরা হল : ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর একবার আছর ছালাতের জামাআত ছুটে গিয়েছিল। সেজন্য নিজেকে শাস্তি স্বরূপ তিনি এক খন্ড জমি দান করে দেন। যার মূল্য ছিল দুই লক্ষ দিরহাম!!
ইবনু ওমর (রাঃ)-এর কোন ছালাতের জামাআত ছুটে গেলে সেদিন তিনি পুরো রাত ইবাদত-বন্দেগীতে কাটাতেন!!
একবার ওমর বিন আব্দুল আযীয (রহঃ)-এর মাগরিবের ছালাত আদায়ে এতটুকু বিলম্ব হয়েছিল যে, সন্ধ্যাকাশে দুটো তারা নযরে আসছিল। তাতেই তিনি দুজন গোলাম আযাদ করে দিয়েছিলেন, যদিও মাগরিব ছালাতের ওয়াক্ত তখনও শেষ হয়নি!!
ইবনু আবী রবীআ (রহঃ)-এর একবার ফজরের দুরাকআত সুন্নাত ছুটে গিয়েছিল। সেই দুঃখে তিনি একটি গোলাম আযাদ করে দিয়েছিলেন!!
ইবনু আওন (রহঃ)-কে তার মা ডাক দিলে তিনি তার  ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে তার কণ্ঠস্বর মায়ের কণ্ঠস্বর থেকে একটু উঁচু হয়ে গিয়েছিল। তাতেই তিনি দুদুজন গোলাম আযাদ করে দিয়েছিলেন!!
সুতরাং পূর্বসূরীরা নিজেকে শাস্তিদান বলতে মনকে নেক কাজে লাগানো এবং যিকির-আযকার ও দোআ-ওযীফায় মশগূল রাখা বুঝতেন। যে সকল হাদীছে অল্প আমলে অনেক ছওয়াবের উল্লেখ আছে সেগুলো নিয়ে গভীর অনুধাবন ও আমল করাও নফসকে শাস্তিদানে সহায়ক।
আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আছ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ قَامَ بِعَشْرِ آيَاتٍ لَمْ يُكْتَبْ مِنَ الْغَافِلِينَ وَمَنْ قَامَ بِمِائَةِ آيَةٍ كُتِبَ مِنَ الْقَانِتِينَ وَمَنْ قَامَ بِأَلْفِ آيَةٍ كُتِبَ مِنَ الْمُقَنْطَرِينَ যে ব্যক্তি  (রাত জেগে ছালাতে) দশটি আয়াত পড়বে তার নাম গাফিল-অলসদের তালিকায় লেখা হবে না। আর যে (রাত জেগে ছালাতে) একশআয়াত পড়বে তার নাম কানিতুনবা অনুগতদের তালিকায় লেখা হবে। আর যে (রাত জেগে ছালাতে) এক হাযার আয়াত পড়বে তাকে মুকান্তারুনবা প্রাচুর্যময়দের তালিকাভুক্ত করা হবে
কোন মুসলমান এই হাদীছ ও এ ধরনের অন্যান্য হাদীছ মনোযোগসহ লক্ষ্য করলে তার জীবনের অনেক মুহূর্ত যে অহেতুক ব্যয় হয়ে গেছে এবং শুধুই নিজ দেহকে আরাম দেওয়ার জন্য যে কত ছওয়াব থেকে সে বঞ্চিত হয়েছে তা ভেবে সে অনুশোচনায় কাতর হয়ে পড়বে এবং এ ধরনের অল্প আমল কিন্তু অধিক ছওয়াবময় কাজে নিজেকে সাগ্রহে নিয়োজিত করে তুলবে।
অতীতের মুজতাহিদ ও সাধকগণ আল্লাহর পথে কী পরিমাণ সাধনা ও ত্যাগ স্বীকার করেছেন তার ইতিহাস এবং পূর্বসূরীদের জীবনপথের নানা ঘটনা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করলেও নিজের নফস বা মনকে বেশী বেশী ইবাদত-বন্দেগী এবং মুস্তাহাব ও নফল আমলে নিয়োজিত করে শাস্তিদানের ইচ্ছা জাগবে। যদিও আজকের যুগে তাদের মত সাধক মানুষের উদাহরণ মেলা ভার।
কাসেম বিন মুহাম্মাদ (রহঃ) বলেন, ‘আমার সকালে হাঁটা-হাটির অভ্যাস ছিল। আর হাঁটতে বের হলেই আমি প্রথমে (আমার ফুফু) আয়েশা (রাঃ)-এর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে সালাম দিতাম। একদিন আমি তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখলাম তিনি ছালাতুয যুহা বা চাশতের ছালাত আদায় করছেন এবং তাতে নিম্নের আয়াত বারবার পড়ছেন আর কেঁদে কেঁদে দোআ করছেন। فَمَنَّ اللهُ عَلَيْنَا وَوَقَانَا عَذَابَ السَّمُومِ অতঃপর আল্লাহ আমাদের উপর অনুগ্রহ করেছেন এবং আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করেছেন (তূর ৫২/২৭)
সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার বিরক্তি ধরে এল, কিন্তু তিনি তা পুনরাবৃত্তি করেই চলেছিলেন। এমন অবস্থা দেখে আমি ভাবলাম, বাজারে আমার একটু প্রয়োজন আছে, প্রয়োজন সেরে না হয় আবার আসব। বাজার থেকে আমার কাজ সেরে বেশ কিছুক্ষণ পর আমি ফিরে এসে দেখি, তিনি আগের মতই একই আয়াত পুনরাবৃত্তি করছেন, আর কেঁদে কেঁদে দোআ করছেন।
আবু দারদা (রাঃ) বলেন, ‘তিনটি জিনিস না থাকলে আমি এক দিনের জন্যও বেঁচে থাকতে পসন্দ করতাম না। এক- দুপুর রোদে আল্লাহর জন্য পিপাসিত হওয়া (আল্লাহর দ্বীন প্রচার ও জিহাদের উদ্দেশ্যে মরুভূমির উত্তাপ সহ্য করা এবং তৃষ্ণার্ত হওয়ার মজা)। দুই- মধ্যরাতে সিজদাবনত হওয়া (তাহাজ্জুদ ছালাত আদায় ও তাতে কুরআন পড়ার মজা)। তিন- সেসব লোকের সঙ্গে ওঠা-বসার সুযোগ, যারা উৎকৃষ্ট ফল বেছে বেছে সংগ্রহের মতো বেছে বেছে ভালো ভালো কথা সংগ্রহ করে।
তাবেঈ মাসরূক (রহঃ)-এর স্ত্রী বলেন, মাসরূক এত দীর্ঘ সময় ধরে ছালাত আদায় করতেন যে, দাঁড়িয়ে থাকার দরুন বেশীর ভাগ সময় তার পা দুটো ফুলে থাকত। আল্লাহর কসম! তার প্রতি অনুকম্পা বশত আমি অনেক সময় তার পেছনে বসে কাঁদতাম।
রবী (রহঃ) (আল্লাহর ভয়ে) এত বেশী কাঁদতেন এবং রাত জেগে ইবাদত করতেন যে, তার মা ছেলের জীবন নাশের আশঙ্কা করতেন। একদিন তিনি তাকে বললেন, প্রিয় পুত্র আমার! তোমার হাতে কেউ হয়তো নিহত হয়েছে? রবী (রহঃ) বললেন, হ্যঁা মা, হয়তো তা হবে! মা বললেন, বৎস আমার,  বলো তো, এই নিহত লোকটা কে হতে পারে, যার হত্যাকারীকে তার পরিবারের কাছে নিয়ে গেলে তারা হত্যাকারীর অবস্থা দেখে তাকে ক্ষমা করে দিবে? আল্লাহর কসম! নিহতের পরিবার যদি তোমার এত কান্নাকাটি ও রাত জাগার কথা জানতে পারে তাহলে তাদের মনে তোমার প্রতি অবশ্য করুণা জাগবে। তখন রবী (রহঃ) বুঝতে পেরে বললেন, هى نفسي সেই নিহত লোকটা হল আমার নফস বা মন। (অর্থাৎ তিনি তার নফসকে কান্না ও রাত জাগার কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলেছেন)।

মনকে শাস্তি প্রদানের সীমাঃ
একজন মুসলিমের নিজ মনকে এমনভাবে পরিচালনা করা কর্তব্য, যাতে আখিরাতে সে নাজাত পেতে পারে। এজন্য সে মনের সঙ্গে সংগ্রাম (মুজাহাদা) করবে, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে ভাল কাজে লাগাবে। যখন সে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়বে তখন তার সাথে সদাচার (মুদারাত) করবে এবং কষ্ট দেওয়া বন্ধ রাখবে। এভাবে সংগ্রাম ও সদাচারের মধ্য দিয়ে না চললে মন ঠিক থাকবে না।
যখন দেখবে, মন বেশ নির্ভয় ও নিশ্চিন্ত হয়ে আছে তখন তাকে আল্লাহর কথা স্মরণ ও তাঁকে ভয় করতে বলবে। আবার যখন দেখবে, মন বিচলিত ও হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে তখন তার মাঝে আল্লাহর নিকটে ভাল ফল লাভের আশা জাগাবে। এভাবেই মনের পরিচালনা ও পরিচর্যা করতে হবে।
অনেক সময় মনোলোভা কিছু বিষয় মনের সামনে তুলে ধরবে। তাকে বুঝাবে যে, তুমি এটা করলে এ পুরস্কার পাবে। তখন তার জন্য অনেক সৎকাজ করা সহজ হয়ে যাবে। ইবনুল জাওযী (রহঃ) বলেন, একবার আমার পাশ দিয়ে দুজন কুলি একটা গাছের ভারী গুঁড়ি বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। ওরা গান গাচ্ছিল আর পথ চলছিল। দুজনের একজন অন্যজন কী বলে তা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল, অতঃপর তার কথার পুনরাবৃত্তি করছিল অথবা তার মতো কিছু একটা বলছিল। প্রথমজনও আবার দ্বিতীয় জনের কথা খেয়াল করছিল। আমি ভেবে দেখলাম, তারা দুজন যদি এভাবে গান না গাইত তাহলে তাদের কষ্ট বেড়ে যেত এবং গাছের গুঁড়ি বহন দুষ্কর হয়ে পড়ত। কিন্তু এখন যেই তারা গান গাইছে অমনি তাদের জন্য বোঝা বহন সোজা হয়ে আসছে। কেন তা সহজ হচ্ছে, আমি তার কারণও ভেবে দেখলাম। বুঝতে পারলাম, প্রত্যেকের মনোসংযোগ অন্যে কী বলছে তার প্রতি নিবদ্ধ হচ্ছে। আবার নিজেও অনুরূপ জবাব দানের চেষ্টা করছে। এভাবেই তাদের পথ কেটে যাচ্ছে; গুঁড়ি বহনের কথা মনেই আসছে না।
এখান থেকে আমি একটা আজব শিক্ষা পেলাম। আমি খেয়াল করলাম, মানুষকেও তো অনেক কঠিন কঠিন দায়িত্ব পালন করতে হয়। তন্মধ্যে সবচেয়ে কঠিন দায়িত্ব, মন যা ভালবাসে তা থেকে তাকে বিরত রাখা এবং যা ভালবাসে না তা করতে তাকে অনুপ্রাণিত করার মাধ্যমে মনকে বাগে আনা এবং তাকে এ অবস্থায় ধৈর্য ধরানোর সাধনা। আমি বুঝতে পারলাম, ধৈর্যের সাধনায় মনকে পাকাপোক্ত করতে হলে তাকে সান্ত্বনা যোগানো ও তার সঙ্গে মজা করার মতো কিছু একটা করতে হবে।

নেককারদের জীবনে মুহাসাবার কিছু নমুনা
১. আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ)  আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার আমার পিতা শপথ করে বললেন, ‘মানবকুলে আমার নিকট ওমর থেকে অধিক প্রিয় আর কেউ নেই। তারপর তিনি কথাটি প্রত্যাহারের লক্ষ্যে বললেন, ‘বেটি, বলতো কথাটা আমি কিভাবে কি বলেছি? তিনি বললেন, আপনি বলেছেন, ‘মানবকুলে আমার নিকট ওমর থেকে অধিক প্রিয় আর কেউ নেই। তিনি বললেন, ‘অধিক সম্মানিত
দেখুন! কীভাবে তিনি একটা শব্দ বলার পর নিজের মনে তা নিয়ে চিন্তা করলেন এবং অন্য শব্দ দিয়ে তা বদলে দিলেন! কেননা তাঁর কাছে মনে হয়েছে অধিক প্রিয়স্থলে অধিক সম্মানিত’-ই বেশী সূক্ষ্ম এবং বেশী যথার্থ।
২. ওমর ফারূক (রাঃ) আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন আমি ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর সংগে বাইরে বের হলাম। চলতে চলতে তিনি একটা বাগানে ঢুকে গেলেন। তাঁর আর আমার মাঝে তখন একটা দেয়ালের ব্যবধান। তিনি বাগানের ভেতরে। আর আমি (বাইরে থেকে) তাঁকে বলতে শুনলাম, ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব! আমীরুল মুমিনীন! সাবাস!! সাবাস!! আল্লাহর কসম, হয় তুমি আল্লাহকে ভয় করবে, নয়তো আল্লাহ তোমাকে শাস্তি দিবেন।
তিনি আমীরুল মুমিনীননামে আখ্যায়িত করে নিজেকে বুঝিয়েছেন যে, এসব উপাধি আল্লাহর সামনে তাঁর কোনই উপকারে আসবে না। 
৩. আমর ইবনুল আছ (রাঃ) ইবনু শিমাসা আল-মাহরী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমর বিন আছ (রাঃ)-এর মরণকালে আমরা তাঁর কাছে হাযির ছিলাম। তিনি দীর্ঘক্ষণ ধরে কান্নাকাটি করলেন এবং দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে রাখলেন। তখন তাঁর ছেলে বলতে লাগলেন, আববা, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গ লাভের পরও কি এ চিন্তা! আববা, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গ লাভের পরও কি এ চিন্তা!!
তিনি তখন মুখ ফিরিয়ে বললেন, আমরা যা সবচেয়ে উত্তম গণ্য করি তা হ, কালিমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ’ (আল্লাহ ছাড়া কোন মাবূদ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল)-এর সাক্ষ্য দান। আমার জীবনের তিনটি পর্যায় আমি অতিবাহিত করেছি। একসময় ছিল যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে আমার থেকে অধিক ঘৃণাকারী দ্বিতীয় কেউ ছিল না। সেসময় তাঁকে বাগে পেলে হত্যা না করা পর্যন্ত আমার মনে স্বস্তি মিলত না। ঐ অবস্থায় মারা গেলে আমি হতাম জাহান্নামী।
তারপর যখন আল্লাহ তাআলা আমার অন্তরে ইসলামের আকর্ষণ পয়দা করলেন তখন আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এসে বললাম, ‘আপনার ডান হাত প্রসারিত করুন, আমি আপনার নিকট বায়আত হব (আনুগত্যের শপথ করব)। তিনি তাঁর ডান হাত প্রসারিত করে দিলেন, কিন্তু আমি আমার হাত টেনে নিলাম। তিনি বললেন, ‘আমর, তোমার কী হ? আমি বললাম, ‘আমি একটা শর্ত করতে চাই। তিনি বললেন, ‘কী শর্ত? আমি বললাম, ‘আমাকে যেন মাফকরে দেওয়া হয়। তিনি বললেন, ‘ইসলাম তার পূর্বেকার সকল গুনাহ নিশ্চিহ্ন করে দেয় এবং হিজরত তার পূর্বেকার সকল গুনাহ নিশ্চিহ্ন করে দেয় এবং হজ্জ তার পূর্বেকার সকল গুনাহ নিশ্চিহ্ন করে দেয়। এভাবে ইসলাম গ্রহণের পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে (আমার অন্তরে) অধিক প্রিয় এবং আমার চোখে অধিক মর্যাদাশালী দ্বিতীয় আর কেউ ছিল না। তাঁর বড়ত্ব ও মহত্ত্ব আমার চোখে এতটাই ভরপুর হয়ে ধরা দিত যে, তাঁকে দুচোখ ভরে দেখার সামর্থ্য আমার হত না। আমাকে যদি তাঁর দৈহিক রূপ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়, তবে আমি তা বলতে পারব না। কারণ আমি তাঁকে দুচোখ ভরে দেখতে পারিনি। ঐ অবস্থায় মারা গেলে আমার জান্নাতবাসী হওয়ার আশা ছিল। তারপর আমি অনেক রকমের দায়িত্বে জড়িয়ে পড়েছি। জানি না তাতে আমার অবস্থা কী দাঁড়াবে।
অবশ্য আমি যখন মারা যাব তখন যেন আমার সাথে কোন মাতমকারিণী না যায়, আর না কোন আগুন সাথে নেওয়া হয়। তারপর যখন তোমরা আমাকে দাফন করবে (মাটির নীচে রাখবে) তখন মাটির উপর ভাল করে পানি ছিটিয়ে দিবে। পরিশেষে তোমরা একটা উট যবেহ করে তার গোশত বিতরণ পর্যন্ত যে সময় লাগে সেই পরিমাণ সময় আমার কবরের পাশে অবস্থান করবে। যাতে করে আমি তোমাদের বিচ্ছেদকে মানিয়ে নিতে পারি এবং আমার রবের দূতদের সঙ্গে আমি কী কথোপকথন করতে পারব তা ভাবতে পারি
৪. হানযালা আল-উসায়দী (রাঃ) হানযালা আল-উসায়দী (রাঃ) ছিলেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর একজন অহী লেখক। তিনি বলেন, একবার আবুবকর (রাঃ)-এর সাথে আমার সাক্ষাৎ হলে তিনি বললেন, হানযালা, কেমন আছ? আমি বললাম, হানযালা তো মুনাফিক হয়ে গেছে! তিনি বললেন, সুবহানাল্লাহ! আরে তুমি বলছ কি? আমি বললাম, আমরা যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট থাকি আর তিনি আমাদের সামনে জান্নাত-জাহান্নামের আলোচনা করেন তখন তো মনে হয় আমরা সরাসরি তা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মজলিস থেকে চলে এসে স্ত্রী, সন্তান-সন্ততির সাথে মিশি এবং পেশাগত কাজে জড়িয়ে পড়ি, তখন অনেক কিছুই ভুলে যাই। আবুবকর (রাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম! আমারও তো এমন অবস্থা হয়। তখন আবুবকর (রাঃ) ও আমি গিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করলাম এবং বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, হানযালা মুনাফিক হয়ে গেছে! রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, কীভাবে? আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমরা যখন আপনার নিকটে থাকি আর আপনি আমাদের সামনে জান্নাত-জাহান্নামের আলোচনা করেন তখন তো মনে হয় আমরা সরাসরি তা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু যখন আপনার নিকট থেকে চলে এসে স্ত্রী, সন্তান-সন্ততির সাথে মিশি এবং পেশাগত কাজে জড়িয়ে পড়ি তখন অনেক কিছুই ভুলে যাই। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘যার হাতে আমার জীবন তার কসম! তোমরা আমার নিকট যে অবস্থায় থাক সে অবস্থা যদি সদাসর্বদা বজায় রাখতে পারতে এবং যিকিরে মশগূল থাকতে পারতে তাহলে ফেরেশতারা ঘরে-বাইরে তোমাদের সাথে মুছাফাহা বা করমর্দন করত। কিন্তু হে হানযালা! সময় সময় অবস্থার হেরফের হয়। একথা তিনি তিনবার বললেন
৫. আলী বিন হুসাইন (রাঃ) ইমাম যুহরী (রহঃ) বলেন, আমি যায়নুল আবেদীন আলী বিন হুসাইন (রহঃ)-কে তার নিজের নফসের হিসাব নিতে এবং স্বীয় রবের নিকট মুনাজাত করতে শুনেছি। তিনি বলছিলেন, হে আমার মন! আর কত দিন তুমি দুনিয়ার ধোঁকায় পড়ে থাকবে? কত কাল তোমার ঝোঁক দুনিয়া আবাদের দিকে থাকবে? তুমি কি তোমার বিগত পূর্বপুরুষদের থেকে; যমীনের কোলে আশ্রয় নেওয়া তোমার মহববতের লোকদের থেকে; অন্তরে ব্যথা জাগানিয়া ভাইদের থেকে এবং তোমার দুর্বলদেহী বন্ধুদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে না? কালের কুটিল চক্রের আবর্তে কত কিই না ধ্বংস হয়ে গেছে! কত ধরনের মানুষের সাথে তুমি ওঠাবসা করেছ এবং কতজনকে তুমি কবরের মাঝে বিদায় জানিয়েছ! যমীন তাদের সব কিছু পাল্টে দিয়েছে এবং মাটির তলে অদৃশ্য করে দিয়েছে!
আর কতকাল তুমি দুনিয়ার পানে ছুটবে? কতকাল দুনিয়ার খাহেশে মজে থাকবে? একদিকে বার্ধক্য তোমাকে পেয়ে বসেছে। সতর্ককারী তোমার দ্বারে পৌঁছে গেছে। অন্যদিকে তুমি জীবনের লক্ষ্য ভুলে বসে আছ এবং ঘুমঘোরে অচেতন পড়ে আছ। অতীত জাতি ও বিলুপ্ত রাজ্যসমূহের কথা একবার চিন্তা করো। কালচক্র কিভাবে তাদের ধ্বংস করে দিয়েছে এবং মৃত্যু কিভাবে তাদের পাকড়াও করেছে? দুনিয়া থেকে তাদের সকল চিহ্ন মুছে গেছে। এখন তাদের বাড়িঘর ও স্মৃতিগুলো শুধুই ইতিহাস হয়ে আছে। কত শক্তিধর রাজা-বাদশাহ, সৈন্যসামন্ত ও পাত্রমিত্র এই দুনিয়াতে ছিল। দুনিয়াতে তারা কত ক্ষমতার মালিক হয়েছিল। তাদের জাগতিক ইচ্ছাগুলো তারা অকপটে পূরণ করেছিল। বহু প্রাসাদ ও মিলনায়তন তারা বানিয়েছিল এবং মূল্যবান জিনিসপত্র ও ধন-সম্পদ জমা করেছিল। একদিন আল্লাহর পক্ষ থেকে অমোঘ হুকুম এসে সব তছনছ করে দিল। তার অপ্রতিরোধ্য ফায়ছালা (মৃত্যু) তাদের আঙিনায় হানা দিল। রাজাধিরাজ, প্রবল প্রতাপান্বিত, বড়াইকারী ও পরাক্রমশালী মহান আল্লাহ এই পৃথিবীতে বলদর্পী স্বৈরাচারীদের মূলোৎপাটনকারী এবং অহংকারীদের বিনাশকারী।
সুতরাং দুনিয়া ও তার চক্রান্ত থেকে সাবধান!! দুনিয়া তোমার জন্য কত ফাঁদ পেতেছে! তোমাকে ভুলাতে কত সাজগোজ করেছে! তোমাকে ধরতে কত রূপ-রস যাহির করেছে! এসব থেকে সাবধান!! জলদি করো, জলদি করো, নিজেকে বাঁচাও। দুনিয়া নিশ্চিতই ধ্বংস হয়ে যাবে এবং তার স্থায়িত্বের কোনই আশা নেই জেনেও কি কোন বুদ্ধিমান মানুষ তার প্রতি লোভী হতে পারে? নাকি কোন অভিজ্ঞজন তাতে খুশী হতে পারে?
যে রাতে দস্যু-তস্করের আক্রমণের ভয় করে তার দুচোখ কিভাবে নিদ্রা যায়? যে মৃত্যুর তোয়াক্কা করে তার মন কিভাবে আরামে থাকে? দুনিয়াতে কত চিত্তাকর্ষক জিনিসই না রয়েছে। তা পেতেও কত শ্রম ব্যয় করতে হয়। কত রোগ-শোক, ব্যথা-বেদনা ও দুঃখ-কষ্ট পোহাতে হয়। তারপরও যে দুনিয়াদার মানুষ তার মজা লাভ করতে পারবে বা তার চাকচিক্য উপভোগ করতে পারবে, তেমনটা আশা করা যায় না।
কত যে অটুট স্বাস্থ্যধারী বর্ষীয়ান মানুষ দুনিয়ার ধোঁকায় পতিত হয়েছে! তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়া কতজনকে যে সে তার কুস্তির প্যাঁচে কুপোকাত করেছে! দুনিয়ার ধোঁকা থেকে সে আর উদ্ধার পায়নি। কুপোকাত অবস্থা থেকেও দুনিয়া তাকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে দেয়নি। দুনিয়ার মোহকেন্দ্রিক তার ব্যথা-বেদনা ও রোগ-ব্যাধির সবই রয়ে গেছে। কোনটা থেকেই তার আরোগ্য ও নিষ্কৃতি মেলেনি। 
সুতরাং হে মন! তুমি তোমার আখিরাত দিয়ে আর কত তোমার দুনিয়াকে তালি দিবে এবং তোমার খেয়াল-খুশীর রঙিন ঘোড়া দাবড়াবে? আমি দেখছি, তুমি একজন দুর্বল চিত্তের মানুষ। হে দ্বীনের ওপর দুনিয়াকে প্রাধান্য দানকারী! তোমাকে কি এ আদেশ দিয়েছেন দয়াময় রহমান? নাকি এ সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে আল-কুরআন?
৬. আল-হারিছ মুহাসিবী (রহঃ) হারিছ মুহাসিবী (রহঃ) ছিলেন সংসারে অনাসক্ত একজন সাধক ও দরবেশ মানুষ। তিনি অতিমাত্রায় তার মনের হিসাব নিতেন বলে তার নাম হয়ে যায় মুহাসিবীবা হিসাব গ্রহণকারী। আল্লামা সামআনী (রহঃ) বলেন, মুহাসিবীকে এ নামে আখ্যায়িত করার কারণ তিনি রীতিমতো তার মনের হিসাব রাখতেন।
৭. ইবনুল জাওযী (রহঃ) আল্লামা ইবনুল জাওযী (রহঃ) নিজের সম্পর্কে বলেন, একদিন আমি একজন অনুসন্ধানী গবেষকের ভঙ্গিতে আমার নফসকে নিয়ে চিন্তা করলাম। ফলে (আল্লাহর দরবারে) তার হিসাব হওয়ার আগে আমি নিজে তার হিসাব নিলাম এবং (আল্লাহর দরবারে) তার ওযন হওয়ার আগে আমি তাকে ওযন করলাম। আমি দেখলাম, সেই শৈশব থেকে আজ অবধি আল্লাহর অনুগ্রহ আমার উপর একের পর এক হয়ে চলেছে। আমার মন্দ কার্যাবলী তিনি গোপন রেখেছেন এবং যে ক্ষেত্রে (দুনিয়াতেই) শাস্তি দেওয়া আবশ্যক ছিল সেক্ষেত্রে আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। অথচ সেজন্য একটু মৌখিক শুকরিয়া ছাড়া আমি আর কিছুই করিনি।
আমি পাপগুলো নিয়ে ভেবে দেখলাম যে, তার কয়েকটার জন্যও যদি আমাকে শাস্তি দেওয়া হত তবে দ্রুতই আমি ধ্বংস হয়ে যেতাম। যদি মানুষের সামনে তার কিছু প্রকাশ পেত তবে আমি লজ্জায় অধোবদন হয়ে যেতাম। এসব কবীরা গুনাহের কথা শুনে একজন বিশ্বাস পোষণকারী আমার বেলায়ও ঠিক তাই বিশ্বাস করত যা ফাসেক-ফাজেরদের বেলায় বিশ্বাস করা হয়। (অর্থাৎ আমাকেও একজন পাপাচারী ফাসেক ঠাওরানো হত।) বরং আমার বেলায় তা আরও কদর্য বিবেচনা করা হ, আর আমি (আত্মপক্ষ সমর্থনে) তার ভ্রান্ত ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে চেষ্টা করতাম। এরপর আমি এই বলে দোআ করি যে, ‘হে আল্লাহ! তোমার প্রশংসার খাতিরে এবং আমার গুনাহের উপর তোমার গোপনীয়তার আচ্ছাদনের বদৌলতে তুমি আমাকে মাফ করে দাও। তারপর আমি আমার নফসকে আল্লাহর এত বড় ও বেশী অনুগ্রহের জন্য তার শুকরিয়া আদায় করতে আহবান জানালাম। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও যেমন শুকরিয়া আদায় করা উচিত ছিল তেমনটা হল না। ফলে আমি আমার ত্রুটি-বিচ্যুতি ও গুনাহ-খাতার জন্য মাতম করতে শুরু করি এবং বড়দের আসন লাভের প্রত্যাশা করতে থাকি। কিন্তু আমার আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে গেল, অথচ সে প্রত্যাশা পূরণ হল না।

শেষ কথাঃ
ব্যক্তির উচিত, প্রত্যহ একটা সময় নির্ধারণ করতঃ সে সময়ে নিজের মনকে তলব করা এবং তার নিকট থেকে তার সকল নড়াচড়া, ওঠাবসা, কাজ-কর্ম ও কথাবার্তার হিসাব নেওয়া। যেমন করে জাগতিক ব্যবসায়ীরা অংশীদারী কারবারে তাদের পাওনার কিছুমাত্র যেন বাদ না যায় সেজন্য তন্নতন্ন করে হিসাব করে। আসলে ব্যক্তির গুনাহ অসংখ্য। তাই মানুষের জন্য সেদিন আসার আগেই প্রতিদিন নিজের হিসাব নেওয়া ভাল, যেদিন তার সারা জীবনের হিসাব একবারে নেওয়া হবে।
এক লোক নিয়মিত মুহাসাবা করত। একদিন সে তার জীবনে কত বছর, কত দিন গুজরে গেছে তা হিসাব করল। সে দেখল,
বছরের হিসাবে তার জীবন থেকে ষাট বছর পেরিয়ে গেছে। তারপর দেখল, ষাট বছরে দিনের সংখ্যা দাঁড়ায় একুশ হাযার পাঁচশত দিন। তখন সে একটা চিৎকার দিয়ে বেহুঁশ হয়ে গেল। হুঁশ ফিরে এলে সে বলল, হায় আফসোস! আমি আমার মালিকের হুযুরে একুশ হাযার পাঁচ শত গুনাহ নিয়ে হাযির হব! তাও তো প্রতিদিন একটা গুনাহ হলে!! আর গুনাহের সংখ্যা অসংখ্য, অগণিত হলে তখন অবস্থা কেমন দাঁড়াবে!! তারপর সে বলল, আহ! আমি আমার দুনিয়া আবাদ করেছি, আমার আখিরাত বিরান করেছি, আর আমার মাওলার নাফরমানী করেছি! এখন আমি আবাদী ভূমি দুনিয়া ছেড়ে বিরান ভূমি আখিরাতে যেতে ইচ্ছুক নই! আর কিভাবেই বা আমি বিনা আমলে ও বিনা ছওয়াবে হিসাব-কিতাব ও আযাব-গযবের জগতে পা রাখব? তারপর সে খুব জোরে একটা চিৎকার দিয়ে চুপ হয়ে গেল লোকেরা তখন তার দেহ নাড়া দিয়ে দেখল তার প্রাণপাখি দেহপিঞ্জর ছেড়ে চলে গেছে।
আমরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার নিকট আমাদের এবং আপনাদের মনের পরিশুদ্ধির জন্য দোআ করি। আর সেই সঙ্গে আল্লাহ ছালাত ও সালাম বর্ষণ করুন আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপর- আমীন!


অনলাইন বুকিং করতে এখানে ক্লিক করুন